হাঁটু ব্যথার আধুনিক চিকিৎসা (ফিজিওথেরাপি)

হাঁটু ব্যথার ধরণ ও করনীয়

হাঁটু ব্যথার আধুনিক চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি একটি গবেষণাভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি, এ পদ্ধাতি আবলম্বন করে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়।
হাঁটুর ব্যথা তিন ধরণের হয়ে থাকে –

. অ্যাকিউট পেইন বা তাৎক্ষণিক যে ব্যথা অনুভূত হয়ঃ আঘাত পাওয়ার ১ থেকে ৭ দিনের মধ্যে যে ব্যথা অনুভূত হয়। এই সময়ে আপনাকে বিশ্রামে থাকতে হবে।
. সাবঅ্যাকিউট পেইনঃ আঘাত পাওয়ার দুই থেকে ছয় সপ্তাহ পরে যে ব্যথা অনুভুত হয়।
. ক্রনিক পেইন বা দীর্ঘমেয়াদী ব্যথাঃ আঘাত পাওয়ার পর আট থেকে বার সপ্তাহের ও বেশি সময় ধরে ব্যথা থাকে।

হাঁটু ব্যথার আধুনিক চিকিৎসা

হাঁটু ব্যথার লক্ষণ ও উপসর্গঃ

যদি ব্যথার তীব্রতা বেশি হয় বা ব্যথা কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনাকে একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক এর শরণাপন্ন হতে হবে। হাঁটুর কোথায় আপনি ব্যথা অনুভব করছেন, ব্যথা কি ভাবে পায়াছেন সেটা সঠিকভাবে আপনার ফিজিওথেরাপিস্টকে জানান, এর পর ফিজিওথেরাপিস্ট আপনার জন্য সঠিক চিকিৎসা নির্ধারন করবেন।

হাঁটুর সামনে ব্যথাঃ

যদি আপনি হাঁটুর সামনে ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে প্যাটেলা বা নীক্যাপের অবস্থানগত সমস্যা থাকতে পারে। মেডিকেল  এর ভাষায় একে প্যাটেলোফিমোরাল স্ট্রেস সিন্ড্রোম বা সংক্ষেপে পিএফএসএস বলে। এক্ষেত্রে হাঁটুর আশে পাশের কাঠামোতে প্রদাহ হয়ে ব্যথার সৃষ্টি করে। হাঁটুর সামনের ব্যথার কারণে রোগী স্বাভাবিকভাবে হাঁটু গেড়ে বসতে, সিড়ি বেয়ে উঠা নামা করতে, লাফ দিতে বা দৌড়াতে পারেন না।

 হাঁটুর ভিতরে ব্যথাঃ

যদি আপনি হাঁটুর ভিতরে ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে সম্ভাবনা আছে যে আপনার রগে টান পড়েছে বা লিগামেন্ট আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। হাঁটুর ভিতরে মিডিয়াল মেনিসক্যাস বা মিডিয়াল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট আছে। সাধারণত খেলা-ধুলায় এই কাঠামোতে আঘাতের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। হাঁটুর ভিতরে অবস্থিত মিডিয়াল মেনিসক্যাস ঘাতশোষক অথবা শক এবসরবার হিসেবে ভূমিকা পালন করে। কখনও কখনো আর্থ্রাইটিস এর কারণে কোন আঘাত প্রাপ্ত না হলেও এই লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

হাঁটুর বাইরে ব্যথাঃ

যদি আপনি হাঁটুর বাইরে ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে হয়তোবা অনেকগুলো কাঠামো আঘাতপ্রাপ্ত অবস্থায় আছে। ক্রীড়াবিদদের কার্যকলাপে সেখানে অবস্থিত লিগামেন্টে ইঞ্জুরি হতে পারে। হাঁটুর বাইরে ব্যথা ইলিওটিবিয়াল ব্যান্ড স্ট্রেসের কারণেও হতে পারে। ইলিওটিবিয়াল ব্যান্ড হচ্ছে টিস্যুর পুরু ব্যান্ড যা কোমর থেকে হাঁটুতে এসেছে। হাঁটুর অস্থিসন্ধিকে অতিক্রম করার সময় এই ইলিওটিবিয়াল ব্যান্ড অস্বাভাবিকভাবে হাঁটুতে ঘষা লাগতে পারে। এর কারণে হাঁটুতে ব্যথার সাথে জলুনিও অনুভুত হতে পারে। আবার, হাঁটুর বাইরেই তিনটি হ্যামস্ট্রিং টেন্ডনের একটি থাকে। এই টেন্ডনে চাপ পড়লে বা টান খেলেও তা হাঁটু ব্যথার কারণ হতে পারে।

হাঁটুর পেছনেব্যথাঃ

হাঁটুর পেছন দিকে ব্যথা সাধারণত হয় না। হ্যামস্ট্রিং টেন্ডনে অত্যধিক চাপ পড়লে ব্যথা হতে পারে। আরেকটি কারণ হচ্ছে ব্যাকার সিস্ট। এই আবস্থায় হাঁটুর অস্থিসন্ধি অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায়। সে কারণে হাঁটুর পেছনের অংশে সংকুলান হয়ে হাঁটুর নড়া-চড়া কারণে ব্যথার সৃষ্টি করে।

 

হাঁটু ব্যথার আধুনিক চিকিৎসার ধাপগুলো:

আপনি কীভাবে হাঁটছেন, তা পরীক্ষা করা। হাঁটার বিভিন্ন পর্যায়ে হাঁটুর চারপাশে গতির কোন সূক্ষ পরিবর্তন হলেও ফিজিওথেরাপিস্ট সেটি ধরতে পারেন।

পালপেশন : এই ধাপে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক হাঁটুর চারোদিকে কাঠামো স্পর্শ করে দেখেন, কোন গঠনগত অস্বাভাবিকতা আছে কিনা বা হাত এর স্পর্শে রোগী ব্যথা অনুভব করছে কিনা।

রেঞ্জ অবমোশন মেজারমেন্ট: রেঞ্জ অব মোশন বলতে বোঝায় হাঁটু বাকালে বা সোজা করলে তা কত টুকু দূর যায় ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক গোনিওমিটার নামক একটি বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করেও তা পরিমাপ করতে পারেন।

স্ট্রেন্থ মেজারমেন্ট: হাঁটুর চারোদিকে অনেক মাংস পেশির সংযোগ আছে এবং এই পেশি গুলোর শক্তি মেপ করার মাদ্ধমে এটা বোঝা যায় যে রোগীর পায়ের ব্যথা কি পেশি দুর্বলতার কারণে হচ্ছে নাকি ভারসাম্যহীনতার কারণে হচ্ছে।

ব্যালেন্স এসেসমেন্ট : যদি আপনার ভারসাম্য ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে সেটি সরাসরি আপনার হাঁটুতে অতিরিক্ত চাপ প্রদান করে। যার কারণে ব্যথা হয়।

শোয়েলিং মেজারমেন্ট: মাঝে মাঝে, আঘাত পাওয়ার পরে হাঁটুর অস্থিসন্ধি ফুলে যেতে পারে। একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক কতটুকু ফুলেছে, তা পরিমাপ করে সরাসরি চিকিৎসা দিতে পারেন।

স্পেশাল টেস্ট: কিছু বিশেষ পরীক্ষা আছে, যা গবেষণাভিত্তিক এবং যার মাধ্যমে হাঁটু ব্যথার পিছনে কোন কাঠামোগত ত্রুটি দায়ী, তা বের করা যায়।

হাঁটু ব্যথার চিকিৎসায় ফিজিওথেরাপি টেকনিক:

থেরাপির ব্যায়ামঃ

একাধিক গবেষণায় পাওয়া গেছে, হাঁটু ব্যথার চিকিৎসায় থেরাপিউটিক ব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। ফিজিওথেরাপিস্ট দ্বারা প্রেসক্রাইব করা থেরাপিউটিক ব্যায়াম ব্যথা কমিয়ে অস্থিসন্ধির নমনীয়তা ( জয়েন্ট ফেক্সিবিলিটি) পুনরুদ্ধার করে। একই সাথে অস্থিসন্ধির চারপাশে অবস্থিত পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে, যা ভবিষ্যৎ এ আঘাতের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। হাঁটু ব্যথার কারণ, ধরণ এবং অবস্থান অনুযায়ী, ফিজিওথেরাপিস্ট প্রেসক্রাইব করতে পারেন –

  • হ্যামস্ট্রিংস্ট্রেচ
  • কাফস্ট্রেচ
  • স্ট্যান্ডিংকোয়াড্রিসেপসস্ট্রেচ
  • সীটেডলেগরেইজ
  • স্টেপআপ
  • স্ট্রেইটলেগলিফট
  • সিংগেললেগডিপস
  • হ্যামস্ট্রিংকার্লস
  • স্ট্যাটিকহ্যামস্ট্রিংকনট্রাকশন
  • হিলকর্ডস্টেচ
  • লেগএক্সটেনশন
  • হিপএবডাকশনএন্ড এডাকশন
  • লেগপ্রেসেসউইদ রেজিস্টেন্স ব্যান্ড
  • ওয়ালস্কোয়াট
  • হাফস্কোয়াট
  • নীস্ট্যাবিলাইজিংসিরিজ

হাঁটুতে আঘাত বা সার্জারির পর আপনার শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে তৈরী করা থেরাপিউটিক ব্যায়াম এর পরিকল্পনা আপনাকে শীঘ্রই দৈনন্দিন কাজে ফিরে আসতে সহায়তা করবে। নিরাপদে থাকতে, ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে, ব্যায়ামগুলো করুন। অন্যথায়, ব্যথা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক আপনাকে দেখিয়ে দিবেন কীভাবে হাঁটুর অস্থিসন্ধিতে অতিরিক্ত চাপ প্রদান ছাড়াই নিরাপদে ব্যায়ামগুলো করবেন।

হাঁটু ব্যথার কারণ যাই হোক না কেন, ব্যায়াম ব্যথা উপশনে সাহায্য করবেই। প্রথমত, ব্যায়াম হাঁটুর চারপাশের পেশিগুলোকে শক্তিশালী করে। দ্বিতীয়ত, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে, যা অস্থিসন্ধির উপর থেকে অতিরিক্ত চাপ পড়া থেকে বাঁচিয়ে দেয়। পেশি শক্ত থাকলে তা ইঞ্জুরির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এইজন্য পেশির জন্য টার্গেটেড প্রেসক্রাইবড স্ট্রেনদেনিং এবং স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ গুলো করা জরুরি।

ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকরা প্রোপিয়োসেপশন এবং ভারসাম্য ব্যায়ামও প্রেসক্রাইব করে থাকেন, বিশেষ করে, আঘাত পাওয়ার পরে। এটি আপনার ভারসাম্য উন্নয়নে সাহায্যকারী এবং একই সাথে আপনার শরীরকে শিখিয়ে দেয় কীভাবে আঘাত পাওয়া অস্থিসন্ধিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

ম্যানুয়াল থেরাপিঃ

থেরাপিউটিক ব্যায়ামের পাশাপাশি, হাঁটু ব্যথার চিকিৎসায় মোবিলাইজেশন এবং ম্যানিপুলেশনের ব্যবহারও হয়ে যায়। এদেরকে ম্যানুয়াল থেরাপি বলা হয়, যা চলাচলের পরিসীমা বা রেঞ্জ অব মোশন বাড়ায় এবং চলাফেরাকে সহজতর করে। ম্যানুয়াল থেরাপি প্রদাহ কমিয়ে ব্যথার উপশম করে। ম্যানুয়াল থেরাপির কিছু টেকনিক হলো –

  • টিবিওফিমোরালজয়েন্টেপোস্টেরিয়োর টু এন্টেরিয়োর মোবিলাইজেশন এবং দি স্কুপ টেকনিক
  • টিবিওফিমোরালজয়েন্টেএন্টেরিয়োর টু পোস্টেরিয়োর মোবিলাইজেশন
  • রোটেশনালমোবিলাইজেশন
  • টিবিওফিমোরালডিসট্রাকশন
  • এন্টেরিয়োরগ্লাইড
  • পোস্টেরিয়োরগ্লাইড
  • শিয়ারমোবিলাইজেশন
  • প্যাটেলারমোবিলাইজেশন
  • রোটেশনালগ্লাইড
  • প্যাটেলোফিমোরালগ্লাইডইত্যাদি

ইলেকট্রোথেরাপিঃ

থেরাপিউটিক ব্যায়াম, ম্যানুয়াল থেরাপির পাশাপাশি ইলেকট্রোথেরাপির ব্যবহার হাঁটুব্যথায় আক্রান্ত রোগীর পুনর্বাসন তরান্বিত করে। হাঁটু ব্যথায় ব্যবহৃত কিছু ইলেক্ট্রোথেরাপি মডালিটিস হলো –

  • ট্রান্সকিউটেনিয়াসইলেকট্রিকালনার্ভ স্টিমুলেশন ( টেনস)
  • পালসডশর্টওয়েব থেরাপি
  • আল্ট্রাসাউন্ড
  • এক্সট্রাকরপোরিয়েলশকওয়েভ থেরাপি ( ইএসডব্লিউটি)

একজন দক্ষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক হাঁটু ব্যথার কারণ বের করে নানা ধরণের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন, যার সবগুলোই গবেষণাভিত্তিক। হাঁটু ব্যথায় সার্জারি আপনার সর্বশেষ অবলম্বন হওয়া উচিত। ঔষধ ব্যথা কমায় কিন্ত এর ফলাফল সাময়িক। তার উপর, অধিকাংশ ঔষধের কোন না কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে, যার বিরুপ প্রভাব পুরো শরীরের উপর পড়ে। ফিজিওথেরাপিই সবচেয়ে নিরাপদ চিকিৎসা।

 

সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নসমূহঃ

কোন খাবার হাঁটুর জন্য ভালো?

স্বাস্থ্যকর জয়েন্ট এর জন্য সেরা খাবার বীজ এবং বাদাম। বীজ এবং বাদাম স্বাস্থ্যকর ওমেগা -3 ফ্যাটি অ্যাসিড। এছাড়া হাটুঁর জন্য ভালো ফল, সবজি, আস্ত শস্যদানা, মটরশুটি এবং মসুর ডাল।

কিসের অভাবে হাঁটুতে ব্যথা হয়?

ভিটামিন ডি এর অভাব এবং কোয়াড্রিসেপস পেশী দুর্বলতা উভয়ই হাঁটু অস্টিওআর্থারাইটিস (KOA) এবং ব্যথার সাথে যুক্ত।

কোন বয়সে হাঁটুর সমস্যা শুরু হয়?

এটি যে কোনও বয়সে যে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে, তবে এটি ৫০ বছরের বেশি লোকেদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

ডিম কি হাঁটুর ব্যথায় সাহায্য করে?

প্রোটিনের একটি বড় উৎস হওয়া ছাড়াও, ডিম ভিটামিন ডি এর একটি প্রাকৃতিক উৎস এবং কিছু ওমেগা -৩ এর সাথে শক্তিশালী। ওমেগা -৩ এবং ভিটামিন ডি উভয়েরই ব্যথা ও হাঁটুর জন্য ভালো। বেশিরভাগ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য একটি সুষম খাদ্যের অংশ হিসাবে প্রতি সপ্তাহে দুটি ডিম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

 

পরিচালনায়ঃ
ডাঃ সাইফুল ইসলাম, পিটি
বিপিটি ( ঢাবি ) , এমপিটি ( অর্থোপেডিকস ) – এন.আই.পি.এস , ইন্ডিয়া
পিজি.সি. ইন আকুপাংচার , ইন্ডিয়া
স্পেশাল ট্রেইন্ড ইন ওজন থেরাপি , ইউ.এস.এ এবং ওজোন ফোরাম , ইন্ডিয়া ।
ফিজিওথেরাপি কনসালট্যান্ট , ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার ।
পরামর্শ পেতে – 01760-636324 , 01932-797229 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) 
ফেসবুকঃ ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার 
এপয়েন্টম্যান্ট নিতে ক্লিক করুনঃ
https://visionphysiotherapy.com/appoi..

visionphysiotherapy
visionphysiotherapy
Articles: 147