ভূমিকা
ঘাড়ের ব্যথা আজকাল খুবই সাধারণ একটি সমস্যা, যা ছোট থেকে বড় প্রায় সবার মধ্যেই দেখা যায়। দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার বা মোবাইলে কাজ করা, ভুল ভঙ্গিতে বসা বা ঘুমানো, হঠাৎ করে ঘাড়ে টান লাগা, অথবা মানসিক চাপ – এই সবকিছুই ঘাড় ব্যথার কারণ হতে পারে। অনেক সময় পেশী শক্ত হয়ে যাওয়া বা স্নায়ুর উপর চাপ পড়ার কারণেও ঘাড়ে ব্যথা হয়, যা আপনার জীবনকে বেশ কষ্টকর করে তোলে। তাই এই পোস্টে আমরা ঘাড়ের ব্যথা কমানোর ফিজিওথেরাপি ব্যায়াম দেখবো যা আপনার উপকারে আসবে।
এই ধরনের ঘাড়ের ব্যথা কমাতে ফিজিওথেরাপি ব্যায়ামের গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিক ব্যায়ামের মাধ্যমে ঘাড়ের পেশীগুলো শক্তিশালী হয়, নমনীয়তা বাড়ে এবং রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয়। এর ফলে ব্যথা ধীরে ধীরে কমে আসে এবং ঘাড়ের কার্যক্ষমতা ফিরে আসে। নিয়মিত এই ব্যায়ামগুলো করলে শুধু বর্তমান ব্যথা থেকেই মুক্তি মেলে না, বরং ভবিষ্যতে ব্যথা হওয়ার ঝুঁকিও অনেক কমে যায়।.
হাঁটু ব্যথার জন্য আমাদের সেন্টার কেনো সেরা তা বিস্তারিত জানতে আমাদের এই পোস্টটি দেখে নিন।
তবে, এই ব্যায়ামগুলো শুরু করার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা জরুরি। যদি আপনার ঘাড়ে তীব্র ব্যথা থাকে, কোনো আঘাত পেয়ে থাকেন, অথবা ব্যথার সাথে হাত বা আঙুলে অসাড়তা বা দুর্বলতা অনুভব করেন, তাহলে অবশ্যই একজন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া বা তার পরামর্শ ছাড়া কোনো ব্যায়াম শুরু করা ঠিক নয়। তিনি আপনার অবস্থা দেখে সঠিক নির্দেশনা দিতে পারবেন, যাতে আপনি নিরাপদে ব্যায়ামগুলো করতে পারেন এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।

ব্যায়াম ১: ঘাড়ের পাশের টান (Neck Side Stretch)
- সোজা হয়ে বসুন বা দাঁড়ান: প্রথমে আরামদায়ক ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসুন অথবা দাঁড়ান।
- একপাশে মাথা হেলান: আপনার ডান হাত দিয়ে মাথার বাঁ পাশ ধরুন। এবার ধীরে ধীরে আপনার মাথাকে ডান কাঁধের দিকে হেলাতে থাকুন। খেয়াল রাখবেন, আপনি যেন ঘাড়ে কোনো ব্যথা না পান।
- ১০-১৫ সেকেন্ড ধরে রাখুন: এই অবস্থায় ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ড থাকুন। আপনি ঘাড়ের পাশে একটা হালকা টান অনুভব করবেন।
- পুনরাবৃত্তি করুন: এবার হাত পরিবর্তন করে অন্য পাশেও একই রকমভাবে করুন। অর্থাৎ, বাঁ হাত দিয়ে মাথার ডান পাশ ধরে মাথাকে বাঁ কাঁধের দিকে হেলান। প্রতিটি পাশে ৩ থেকে ৫ বার পুনরাবৃত্তি করুন।
- ধীরে ধীরে করুন: তাড়াহুড়ো না করে খুব ধীরে ধীরে ব্যায়ামটি করুন।
- হঠাৎ টানবেন না: ঘাড়ে হঠাৎ করে জোরে টান দেবেন না, এতে ব্যথা পেতে পারেন।
ঢাকায় কোমর ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার সহজ উপায় জানতে এই পোস্টটি পড়ে নিন।

ব্যায়াম ২: চিবুক পেছনের দিকে টানা (Chin Retraction)
- সোজা হয়ে বসুন বা দাঁড়ান: প্রথমে আরামদায়ক ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসুন অথবা দাঁড়ান। আপনার ঘাড় এবং মেরুদণ্ড যেন সোজা থাকে।
- চিবুক বুকের দিকে টানুন: এবার আপনার মাথাকে সোজা রেখে ধীরে ধীরে আপনার চিবুককে বুকের দিকে টানুন। এমনভাবে টানবেন যেন মনে হয় আপনার ঘাড়টা লম্বা হচ্ছে বা কেউ আপনার মাথার ওপরের অংশ ধরে উপরের দিকে টানছে। আপনার ঘাড়ের পেছনে হালকা টান অনুভব করবেন।
- ৫-১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন: এই অবস্থায় ৫ থেকে ১০ সেকেন্ড থাকুন।
- ১০-১৫ বার পুনরাবৃত্তি করুন: ধীরে ধীরে মাথা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনুন এবং এই প্রক্রিয়াটি ১০ থেকে ১৫ বার পুনরাবৃত্তি করুন।
- মাথা নিচু করবেন না: এই ব্যায়ামের সময় আপনার মাথাকে নিচের দিকে ঝুঁকাতে যাবেন না। শুধু আপনার চিবুককে পেছনের দিকে টানুন।
- ধীরে ধীরে করুন: তাড়াহুড়ো না করে খুব সাবধানে এবং ধীরে ধীরে ব্যায়ামটি করুন।

ব্যায়াম ৩: ঘাড় ঘোরানো (Neck Turn)
- সোজা হয়ে বসুন বা দাঁড়ান: প্রথমে আরামদায়ক ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসুন অথবা দাঁড়ান। আপনার ঘাড় এবং মেরুদণ্ড সোজা রাখুন।
- একপাশে মাথা ঘোরান: এবার আপনার মাথাকে ধীরে ধীরে ডান কাঁধের দিকে ঘোরান। যতদূর সম্ভব ঘোরান, যতক্ষণ না আপনি ঘাড়ের পাশে বা পেছনে একটা হালকা টান অনুভব করেন।
- ৫-১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন: এই অবস্থায় ৫ থেকে ১০ সেকেন্ড থাকুন।
- উভয় পাশে পুনরাবৃত্তি করুন: ধীরে ধীরে মাথাকে আবার সোজা অবস্থায় ফিরিয়ে আনুন। এবার বাঁ কাঁধের দিকে মাথা ঘোরান এবং একই নিয়মে ৫ থেকে ১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন। প্রতিটি পাশে ৩ থেকে ৫ বার এই ব্যায়ামটি পুনরাবৃত্তি করুন।
- ব্যথা হলে জোর করবেন না: যদি ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে কোনো ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে জোর করে বেশি ঘোরানোর চেষ্টা করবেন না। যতটুকুতে আরাম পাচ্ছেন, ততটুকুই করুন।
- ধীরে ধীরে করুন: তাড়াহুড়ো না করে খুব সাবধানে এবং ধীরে ধীরে ব্যায়ামটি করুন।

ব্যায়াম ৪: কাঁধ ঘোরানো (Shoulder Rotation)
- সোজা হয়ে বসুন বা দাঁড়ান: প্রথমে আরামদায়ক ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসুন অথবা দাঁড়ান।
- কাঁধ ঘোরান: আপনার কাঁধ দুটোকে একসঙ্গে সামনের দিকে, তারপর উপরের দিকে, এরপর পেছনের দিকে এবং সবশেষে নিচের দিকে একটা গোলাকার পথে ঘোরাতে থাকুন। এমনভাবে করুন যেন মনে হয় আপনি কাঁধ দিয়ে একটা বড় বৃত্ত আঁকছেন।
- সামনের দিকে এবং পেছনের দিকে ঘোরান: প্রথমে ৫ থেকে ১০ বার সামনের দিকে এভাবে কাঁধ ঘোরান। এরপর দিক পরিবর্তন করে ৫ থেকে ১০ বার পেছনের দিকে ঘোরান।
- বড় এবং মসৃণ বৃত্ত তৈরি করুন: কাঁধ ঘোরানোর সময় চেষ্টা করুন যেন বড় এবং মসৃণ বৃত্ত তৈরি হয়, কোনো ঝাঁকুনি না লাগে।
- ধীরে ধীরে করুন: তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে ব্যায়ামটি করুন।

ব্যায়াম ৫: ট্র্যাপিজিয়াস পেশীর টান (Upper Trapezius Stretch)
- সোজা হয়ে বসুন বা দাঁড়ান: প্রথমে আরামদায়ক ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বসুন অথবা দাঁড়ান।
- এক কানকে কাঁধের দিকে নামান: আপনার মাথাকে ধীরে ধীরে ডান কাঁধের দিকে হেলাতে থাকুন, এমনভাবে যেন আপনার ডান কান ডান কাঁধের দিকে নেমে আসে। একই সময়ে, আপনার বাঁ হাত দিয়ে আপনার বসার চেয়ারের কিনারা অথবা আপনার বাঁ উরু ধরে রাখুন। এতে আপনার বাঁ দিকের ঘাড়ে টান পড়বে।
- ১৫-২০ সেকেন্ড ধরে রাখুন: এই অবস্থায় ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ড থাকুন। আপনি ঘাড়ের পাশে একটা গভীর টান অনুভব করবেন।
- উভয় পাশে পুনরাবৃত্তি করুন: ধীরে ধীরে মাথা সোজা করুন এবং অন্য পাশেও একই রকমভাবে করুন (অর্থাৎ, বাঁ কানকে বাঁ কাঁধের দিকে নামান এবং ডান হাত দিয়ে চেয়ার বা উরু ধরে রাখুন)। প্রতিটি পাশে ২ থেকে ৩ বার এই ব্যায়ামটি পুনরাবৃত্তি করুন।
- কাঁধ উপরে তুলবেন না: যখন আপনি ঘাড় বাঁকাচ্ছেন, তখন আপনার কাঁধকে উপরের দিকে তুলে ফেলবেন না। কাঁধকে নিচে এবং শিথিল রাখুন।
- ব্যথা হলে জোর করবেন না: যদি কোনো ব্যথা অনুভব করেন, তাহলে জোর করে বেশি বাঁকানোর চেষ্টা করবেন না। যতটুকুতে আরাম পাচ্ছেন, ততটুকুই করুন।

উপসংহার
নিয়মিত ব্যায়াম করা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। এটি শুধু ঘাড় বা কাঁধের ব্যথা কমায় না, বরং আমাদের পুরো শরীরকে সচল ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। প্রতিদিন অল্প কিছু সময় ব্যায়ামের জন্য রাখলে পেশীগুলো শক্তিশালী হয়, নমনীয়তা বাড়ে এবং শরীরের রক্ত চলাচল ভালো হয়। এর ফলে আমরা দিনের পর দিন আরও সতেজ ও কর্মঠ অনুভব করি।
যদি আপনার ঘাড়ে বা কাঁধে ব্যথা কমার বদলে বেড়ে যায় অথবা ব্যথা খুব বেশি দিন ধরে থাকে, তবে আর দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ, অনেক সময় সাধারণ ব্যথার পেছনে অন্য কোনো গুরুতর কারণ থাকতে পারে, যা একজন চিকিৎসক পরীক্ষা করে সঠিক নির্ণয় করতে পারবেন এবং উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারবেন। নিজের অনুমান করে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে পেশাদারের সাহায্য নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
সুস্থ ও ব্যথামুক্ত জীবনযাপনের জন্য স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন এবং সঠিক ভঙ্গি মেনে চলা খুবই জরুরি। আমরা কীভাবে বসি, দাঁড়াই বা কাজ করি – এর ওপর আমাদের শরীরের পেশী ও হাড়ের ওপর চাপ পড়ে। তাই সব সময় মেরুদণ্ড সোজা রেখে বসা বা দাঁড়ানোর অভ্যাস করুন। পর্যাপ্ত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার এবং মানসিক চাপ কমানোও সুস্থতার জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়গুলো মেনে চললে শুধু ঘাড়ের ব্যথাই নয়, বরং সামগ্রিক সুস্থতা বজায় রাখা সম্ভব।