শরীরে পালস রেট কম হলে কি হয়? এর চিকিৎসা ও প্রতিকার কি?

হৃৎস্পন্দনের হার বা পালস রেট বলতে বোঝায় প্রতি মিনিটে আপনার হৃৎপিণ্ড কতবার স্পন্দিত হয় বা বিট করে। সাধারণত, একজন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি যখন বিশ্রামরত থাকেন, তখন তার স্বাভাবিক পালস রেট প্রতি মিনিটে ৬০ থেকে ১০০ বারের মধ্যে থাকে। যদি এই হার প্রতি মিনিটে ৬০ বারের নিচে নেমে আসে, সেই অবস্থাকে ব্র্যাডিকার্ডিয়া বা কম পালস রেট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও ঘুমের সময় বা যারা নিয়মিত কঠোর শারীরিক অনুশীলন করেন (যেমন ক্রীড়াবিদ), তাদের ক্ষেত্রে পালস রেট কম থাকা স্বাভাবিক এবং চিন্তার কারণ নয়, তবে অন্য অনেকের জন্য এটি এমন কোনো অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে যা শরীরে রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটায়। শরীরে পালস রেট কম হলে কি হয় ও পালস রেট কম হওয়ার কারণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

হৃৎস্পন্দনের হার যখন অতিরিক্ত কমে যায়, তখন হৃৎপিণ্ড শরীর ও মস্তিষ্কের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত পাম্প করতে পারে না। এর ফলে বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। যেহেতু আমাদের মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করার জন্য নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল, তাই রক্ত প্রবাহের এই ঘাটতি মাথা ঘোরা, শরীর দুর্বল লাগা, অস্বাভাবিক ক্লান্তি, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বুকে ব্যথা, মানসিক বিভ্রান্তি বা স্মৃতিশক্তির সমস্যা এবং এমনকি জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। এই লক্ষণগুলো কেবল দৈনন্দিন জীবনকেই ব্যাহত করে না, ক্ষেত্রবিশেষে এগুলো গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকিরও ইঙ্গিত দেয়।

কম পালস রেটকে কখনোই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়, বিশেষ করে যদি এর সাথে বিভিন্ন উপসর্গ যুক্ত থাকে অথবা বিশ্রাম নেওয়ার সময়েও হার অস্বাভাবিকভাবে কম থাকে। এরূপ পরিস্থিতিতে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা আবশ্যক। চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে এর অন্তর্নিহিত কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করবেন; এটি হতে পারে হৃৎপিণ্ডের সংকেত প্রবাহে কোনো সমস্যা (যেমন হার্ট ব্লক), নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা অথবা অন্য কোনো অজানা শারীরিক অসুস্থতা। সঠিক রোগ নির্ণয় করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ তার ভিত্তিতেই যথাযথ চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, কিছু ক্ষেত্রে ব্র্যাডিকার্ডিয়া গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে, যা এমনকি জীবননাশের কারণও হতে পারে।

মেয়েদের হার্টের সমস্যার লক্ষণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই পোস্টটি পড়ে নিন।

পালস রেট কম হওয়ার কারণ

পালস রেট কম হওয়ার কারণ

ব্র্যাডিকার্ডিয়া (Bradycardia)

প্রথমত, পালস রেট বা হৃৎস্পন্দনের হার কম হওয়ার সাধারণ অবস্থাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ব্র্যাডিকার্ডিয়া (Bradycardia) বলা হয়। এই অবস্থায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির বিশ্রামের সময় হৃৎস্পন্দন প্রতি মিনিটে ৬০ বারের চেয়ে কম থাকে। ব্র্যাডিকার্ডিয়া নিজে কোনো রোগ নয়, বরং এটি একটি লক্ষণ যা বিভিন্ন রকম কারণে ঘটতে পারে।

হৃদপিণ্ডের তড়িৎ সিস্টেমের সমস্যা

দ্বিতীয়ত, ব্র্যাডিকার্ডিয়ার একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো হৃদপিণ্ডের নিজস্ব তড়িৎ সংকেত পরিবহন ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি বা সমস্যা দেখা দেওয়া। হৃৎপিণ্ডের সঠিক ছন্দে স্পন্দিত হওয়ার জন্য একটি জটিল তড়িৎ নেটওয়ার্ক কাজ করে, যার শুরু হয় সাইনাস নোড (SA node) থেকে। যদি সাইনাস নোড যথেষ্ট দ্রুত তড়িৎ সংকেত তৈরি করতে না পারে, অথবা অ্যাট্রিওভেন্ট্রিকুলার নোড (AV node) বা হৃদপিণ্ডের অন্যান্য পরিবহন পথে সংকেত পরিবহনে বাধা (যেমন হার্ট ব্লক) সৃষ্টি হয়, তবে হৃৎস্পন্দনের হার স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যেতে পারে।

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

তৃতীয়ত, নির্দিষ্ট কিছু ওষুধের ব্যবহার পালস রেট কমিয়ে দেওয়ার একটি পরিচিত কারণ। বিশেষ করে, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যারিথমিয়া (অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন) বা অন্যান্য হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ, যেমন বিটা-ব্লকার, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার এবং ডিগক্সিন, হৃৎস্পন্দনের গতিকে ধীর করে দিতে পারে। কিছু মানসিক রোগের ওষুধ বা ব্যথানাশকও এই ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। তাই কোনো নতুন ওষুধ শুরু করার পর পালস রেট কমে গেলে বা ব্র্যাডিকার্ডিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসককে জানানো জরুরি।

উন্নত শারীরিক ফিটনেস

এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে কম পালস রেট সবসময় কোনো অসুস্থতা বা সমস্যার নির্দেশক নয়। উদাহরণস্বরূপ, যারা নিয়মিত কঠোর শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করেন, বিশেষ করে পেশাদার ক্রীড়াবিদদের ক্ষেত্রে, বিশ্রামরত অবস্থায় পালস রেট প্রতি মিনিটে ৬০ বারের নিচে, এমনকি ৪০-এর কাছাকাছি থাকাও স্বাভাবিক। এর কারণ হলো, নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে তাদের হৃদপিণ্ড অনেক বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর হয়ে ওঠে। ফলে, প্রতি স্পন্দনে এটি অধিক পরিমাণে রক্ত পাম্প করতে সক্ষম হয় এবং শরীরের অক্সিজেনের চাহিদা মেটানোর জন্য বিশ্রামের সময় কমবার স্পন্দিত হলেই চলে। এটি মূলত সুস্বাস্থ্য এবং উন্নত কার্ডিওভাসকুলার ফিটনেসেরই লক্ষণ।

পালস রেট কম হলে সম্ভাব্য লক্ষণ

পালস রেট কম হলে সম্ভাব্য লক্ষণ

যখন পালস রেট বা হৃৎস্পন্দনের হার স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়, তখন শরীর ও মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছাতে পারে না। এর ফলে বিভিন্ন শারীরিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই সম্ভাব্য লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা (Dizziness or Weakness)

যখন হৃৎস্পন্দন বা পালস রেট খুব কমে যায়, তখন হৃৎপিণ্ড যথেষ্ট গতিতে রক্ত পাম্প করে শরীর ও মস্তিষ্কে পাঠাতে পারে না। আমাদের মস্তিষ্ক সঠিকভাবে কাজ করার জন্য অবিরাম অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহের উপর নির্ভর করে। এই রক্ত সরবরাহ কমে গেলে বা এর ফলে রক্তচাপ (Blood Pressure) কমে গেলে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়। এর ফলে হঠাৎ মাথা হালকা লাগা, চোখে ঝাপসা দেখা, ভারসাম্য হারানোর অনুভূতি বা মনে হতে পারে চারপাশ ঘুরছে (মাথা ঘোরা)। একই কারণে শরীরে পর্যাপ্ত শক্তি না পৌঁছানোয় হঠাৎ করে খুব দুর্বল লাগতে পারে বা গায়ে জোর পাওয়া যায় না।

ক্লান্তি অনুভব করা (Fatigue)

শরীরের প্রতিটি অঙ্গ এবং পেশীর কাজ করার জন্য এবং শক্তি উৎপাদনের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন, যা রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। পালস রেট কম থাকার মানে হলো রক্ত সঞ্চালন ধীর গতিতে হচ্ছে। ফলে, শরীরের কোষগুলো, বিশেষ করে পেশীগুলো, প্রয়োজন অনুযায়ী অক্সিজেন পায় না। অক্সিজেনের অভাবে কোষগুলো পর্যাপ্ত শক্তি (Energy) উৎপাদন করতে পারে না। এই কারণে ব্যক্তি প্রায়শই অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করেন, অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠেন, কোনো কাজ করতে উৎসাহ পান না এবং সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব বা অবসন্নতা থাকতে পারে।

বুকে অস্বস্তি বা ধড়ফড়ানি (Chest Discomfort or Palpitations)

যদিও পালস রেট কম থাকে, কিছু মানুষ বুকে এক ধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি, যেমন চাপ ধরা, হালকা ব্যথা বা বুক ধড়ফড় করার মতো অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। এর কারণ হতে পারে যে, কম স্পন্দন পুষিয়ে নেওয়ার জন্য হৃৎপিণ্ড হয়তো প্রতিটি বিটে অতিরিক্ত জোর দিয়ে পাম্প করার চেষ্টা করছে। অথবা, যে কারণে পালস রেট কমেছে (যেমন হৃৎপিণ্ডের তড়িৎ সংকেত ব্যবস্থায় সমস্যা), তার ফলেই অনিয়মিত স্পন্দন বা ধড়ফড়ানির অনুভূতি হতে পারে। যদি হৃৎপিণ্ডের পেশী নিজেই রক্ত প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পায়, তবে বুকে ব্যথা বা অ্যানজাইনা (Angina) হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

শ্বাসকষ্ট (Shortness of Breath)

যখন হৃৎপিণ্ড খুব ধীরে রক্ত পাম্প করে, তখন ফুসফুস থেকে সংগৃহীত অক্সিজেনযুক্ত রক্ত দ্রুত শরীরের বাকি অংশে পৌঁছাতে পারে না। শরীরের কোষগুলোতে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিলে, শরীর সেই অভাব পূরণের জন্য দ্রুত শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করে। এর ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয় বা মনে হয় যেন পর্যাপ্ত বাতাস পাওয়া যাচ্ছে না। এই সমস্যাটি সাধারণত হাঁটাচলা বা কোনো শারীরিক পরিশ্রমের সময় বেশি অনুভূত হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে, হৃৎপিণ্ড ঠিকমতো পাম্প করতে না পারার কারণে ফুসফুসে রক্ত বা তরল জমা হতে পারে (Pulmonary Congestion), যা তীব্র শ্বাসকষ্টের কারণ হয়।

অজ্ঞান হয়ে যাওয়া (Fainting বা Syncope)

এটি ব্র্যাডিকার্ডিয়ার একটি অত্যন্ত গুরুতর লক্ষণ। যদি পালস রেট হঠাৎ করে এবং মারাত্মকভাবে কমে যায়, তাহলে মস্তিষ্কে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। মস্তিষ্কের কোষগুলো অক্সিজেনের অভাবে দ্রুত কার্যকারিতা হারাতে শুরু করে, যার ফলে ব্যক্তি কয়েক সেকেন্ডের জন্য সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে চেতনা হারিয়ে ফেলেন, অর্থাৎ অজ্ঞান হয়ে যান। ডাক্তারি ভাষায় একে সিনকোপ (Syncope) বলে। এটি একটি জরুরি অবস্থা, কারণ এটি মারাত্মক অন্তর্নিহিত সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে এবং অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার ফলে গুরুতর আঘাত লাগার ঝুঁকিও থাকে।

কিছু কথা

তাহলে সবশেষে যা বোঝা গেল, হার্টবিট বা পালস রেট কম হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কখনও কখনও হার্টের ভেতরের ইলেক্ট্রিক লাইনে গণ্ডগোল হলে বা হার্টে ঠিকমতো সিগন্যাল না পৌঁছালে হার্টবিট কমে যায়। আবার, যারা ব্লাড প্রেসার বা হার্টের অসুখের জন্য নিয়মিত ওষুধ খান, সেই ওষুধের কারণেও অনেক সময় হার্টবিট কমে যেতে দেখা যায়।

কিন্তু হার্টবিট কম হলেই যে ভয়ের কারণ বা এটা কোনো অসুখের লক্ষণ, তা কিন্তু সবসময় ঠিক নয়। যেমন ধরুন, যারা খেলোয়াড় বা যারা নিয়মিত অনেক ব্যায়াম করে শরীর খুব ফিট রাখেন, তাদের হার্টবিট এমনিতেই একটু কম থাকে। এটা তাদের জন্য স্বাভাবিক এবং ভালো স্বাস্থ্যেরও লক্ষণ। তাই, কারো হার্টবিট কম হলে আসল কারণটা খুঁজে বের করা খুব দরকার। কারণটা ঠিকমতো জানতে পারলেই বোঝা যাবে যে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার, নাকি শরীরের ভেতরে কোনো সমস্যা হচ্ছে যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া বা চিকিৎসা করা প্রয়োজন।

 

লিখেছেন-

ডাঃ সাইফুল ইসলাম, পিটি
বিপিটি ( ঢাবি ), এমপিটি ( অর্থোপেডিকস ) – এন.আই.পি.এস, ইন্ডিয়া
পিজি.সি. ইন আকুপাংচার, ইন্ডিয়া
স্পেশাল ট্রেইন্ড ইন ওজন থেরাপি, ইউ.এস.এ এবং ওজোন ফোরাম, ইন্ডিয়া।
ফিজিওথেরাপি কনসালট্যান্ট, ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার।

পরামর্শ পেতে – 01760-636324 , 01932-797229 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন

আমাদের ফেইসবুক পেইজঃ ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার

Visionphysiotherapy Centre
Visionphysiotherapy Centre
Articles: 103

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *