ভূমিকা
পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা। এটি হালকা থেকে তীব্র হতে পারে এবং স্থায়ী বা অস্থায়ী উভয়ই হতে পারে। নারী ও পুরুষ উভয়ই এই ব্যথায় আক্রান্ত হতে পারেন, তবে কিছু ক্ষেত্রে নারীদের মধ্যে এর প্রবণতা বেশি দেখা যায়। সাধারণত, এই ব্যথা বিভিন্ন কারণে হতে পারে, যা হজমতন্ত্র, মূত্রতন্ত্র, বা প্রজননতন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত। এই পোস্টে পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথা কেন হয় সেটি নিয়ে একটি বিস্তারিত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো।
পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথার একটি প্রধান কারণ হলো হজমতন্ত্রের সমস্যা। কোষ্ঠকাঠিন্য বা গ্যাসের কারণে এই অংশে ব্যথা হতে পারে। অনেক সময় খাদ্যনালীর প্রদাহ (Diverticulitis), যেখানে খাদ্যনালীর ছোট থলির মতো অংশে প্রদাহ হয়, তার কারণেও তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এছাড়া, ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (IBS)-এর মতো কার্যকরী অন্ত্রের সমস্যাও এই ব্যথার কারণ হতে পারে, যা পেট ফাঁপা, ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যের সাথে সম্পর্কিত।
মূত্রতন্ত্রের সমস্যার কারণেও বাম পাশে নিচের পেটে ব্যথা হতে পারে। কিডনিতে পাথর বা মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI) হলে ব্যথা কোমর থেকে পেটের নিচের অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে, ডিম্বাশয়ের সিস্ট বা মাসিকের সময় জরায়ুর সংকোচন (Dysmenorrhea) এই অংশে ব্যথার কারণ হতে পারে। অনেক সময় এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি (Ectopic Pregnancy) বা ডিম্বাশয়ের টর্শন-এর মতো জরুরি অবস্থাও এই ব্যথার কারণ হতে পারে, যা তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রয়োজন।
উপরে উল্লিখিত কারণগুলো ছাড়াও আরও কিছু কারণে বাম পাশে নিচের পেটে ব্যথা হতে পারে। হার্নিয়া বা মাংসপেশীর টান-এর কারণেও এমন ব্যথা অনুভূত হতে পারে। অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা সাধারণত ডান পাশে শুরু হলেও, কিছু ক্ষেত্রে এটি বাম পাশেও অনুভূত হতে পারে, যা বিরল। তাই, যদি ব্যথা তীব্র হয়, দীর্ঘস্থায়ী হয় বা অন্য কোনো উপসর্গের (যেমন জ্বর, বমি বা রক্তপাত) সাথে দেখা যায়, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
গর্ভাবস্থায় জরায়ু নিচে নামার লক্ষণ জেনে নিন।
পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথা হওয়ার সাধারণ কারণসমূহ
পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথার বেশ কিছু সাধারণ কারণ রয়েছে, যা সাধারণত গুরুতর নয় এবং ঘরোয়া উপায়েই এর সমাধান করা সম্ভব। চলুন এমন কিছু সাধারণ কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিইঃ
গ্যাস ও ফোলাভাব
পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথার একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো গ্যাস জমা হওয়া এবং এর ফলে সৃষ্ট ফোলাভাব। আমরা যখন খাবার খাই, হজমের প্রক্রিয়ায় স্বাভাবিকভাবেই কিছু গ্যাস তৈরি হয়। কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট খাবার, যেমন ডাল, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, অতিরিক্ত শর্করাযুক্ত পানীয় বা অতিরিক্ত বায়ু গিলে ফেলার কারণে (যেমন দ্রুত খাওয়া বা চুইংগাম চিবানো) অন্ত্রে অতিরিক্ত গ্যাস জমা হতে পারে। এই অতিরিক্ত গ্যাস যখন অন্ত্রের মধ্যে আটকে যায়, তখন এটি চাপ সৃষ্টি করে এবং পেটের বাম দিকে বা অন্য কোনো অংশে অস্বস্তি ও ব্যথার কারণ হয়। এই ব্যথা সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি হতে পারে এবং কিছুক্ষণ পর কমে যায়।
বদহজম
বদহজম বা ডিসপেপসিয়া হলো আরেকটি সাধারণ কারণ, যা পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে। এটি সাধারণত ঘটে যখন হজম প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হয় না। দ্রুত বা অতিরিক্ত পরিমাণে খাবার খাওয়া, খুব বেশি মশলাদার বা চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া, অথবা খাওয়ার পরপরই শুয়ে পড়লে বদহজম হতে পারে। বদহজমের কারণে পেটে গ্যাস তৈরি হতে পারে, পেট ফুলে যেতে পারে এবং পেটের উপরের বা নিচের অংশে জ্বালাপোড়া বা ব্যথার মতো অনুভূতি হতে পারে। অনেক সময় দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপও বদহজমের কারণ হতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্য
কোষ্ঠকাঠিন্য হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে মলত্যাগে অসুবিধা হয়, মল শুষ্ক ও শক্ত হয়ে যায় এবং মলত্যাগের পরিমাণ কমে যায়। যখন মল অন্ত্রে জমে যায়, তখন এটি অন্ত্রের দেয়ালে চাপ সৃষ্টি করে এবং খিঁচুনি বা ব্যথার কারণ হয়। এই ব্যথা সাধারণত পেটের নিচের অংশে, বিশেষ করে বাম পাশে অনুভূত হতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পান না করা, আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া, বা শারীরিক কার্যকলাপের অভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য পেটে অস্বস্তি এবং ব্যথার একটি সাধারণ কারণ।
অন্ত্র ও কোলনের সমস্যা
পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথার কিছু নির্দিষ্ট কারণ অন্ত্র ও কোলনের বিভিন্ন সমস্যার সাথে সম্পর্কিত। এই সমস্যাগুলো সাধারণ বদহজম বা গ্যাস-ফোলার চেয়েও গুরুতর হতে পারে এবং প্রায়শই চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
ডাইভার্টিকুলাইটিস ও কোলাইটিস
আমাদের কোলনে ছোট ছোট থলির মতো অংশ তৈরি হতে পারে, যাদের ডাইভার্টিকুলা বলা হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এগুলো দেখা যায়। যখন এই থলিগুলোতে কোনো কারণে প্রদাহ হয় বা ইনফেকশন হয়, তখন সেই অবস্থাকে ডাইভার্টিকুলাইটিস বলে। এর ফলে পেটের বাম পাশে নিচের দিকে হঠাৎ করে খুব তীব্র ব্যথা শুরু হতে পারে এবং ব্যথা বাড়তে থাকে। ব্যথার সাথে জ্বর, বমি বমি ভাব, বমি এবং পায়খানার অভ্যাসে পরিবর্তন (যেমন কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া) হতে পারে। ডাইভার্টিকুলাইটিস একটি গুরুতর সমস্যা, যার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক বা কখনো কখনো অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে।
কোলাইটিস মানে হলো কোলনের প্রদাহ বা ইনফেকশন। বিভিন্ন কারণে এটি হতে পারে, যেমন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের সংক্রমণ, শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ভুল আক্রমণের কারণে (যেমন আলসারেটিভ কোলাইটিস বা ক্রোনস ডিজিজ), অথবা কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে। কোলাইটিসের কারণে পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথা হয়, যা সাধারণত পেটে মোচড়ানো বা খিঁচুনির মতো মনে হতে পারে। ব্যথার সাথে পাতলা পায়খানা (অনেক সময় রক্তমিশ্রিত), জ্বর, ওজন কমে যাওয়া এবং পেটে অস্বস্তি দেখা দিতে পারে। কোলাইটিসের কারণ ও ধরনের ওপর নির্ভর করে এর চিকিৎসা করা হয়।
ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (IBS)
ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম (IBS) হলো অন্ত্রের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, যেখানে পেটে ব্যথা, গ্যাস, পেট ফাঁপা এবং পায়খানার অভ্যাসের পরিবর্তন হয়। মজার ব্যাপার হলো, এই রোগে অন্ত্রের গঠন বা গঠনে কোনো সমস্যা থাকে না, কিন্তু এর কাজ করার পদ্ধতিতে সমস্যা হয়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, কোলনের মাংসপেশীর অস্বাভাবিক নড়াচড়া অথবা অন্ত্রের স্নায়ুগুলো বেশি সংবেদনশীল হওয়ার কারণে এটি ঘটে।
IBS-এর প্রধান লক্ষণ হলো পেটের বাম পাশে নিচের দিকে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, যা বারবার ফিরে আসে। এই ব্যথা সাধারণত পায়খানা করার পর কিছুটা কমে যায়। ব্যথার সাথে পেটে গ্যাস, পেট ফাঁপা এবং পায়খানার অভ্যাসে পরিবর্তন দেখা যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে ডায়রিয়া (IBS-D) হয়, আবার কারও কোষ্ঠকাঠিন্য (IBS-C) হয়, আবার কিছু মানুষের দুটোই থাকতে পারে (IBS-M)। IBS একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা হলেও, এটি সাধারণত গুরুতর হয় না বা জীবনের জন্য হুমকি নয়। তবে, এটি দৈনন্দিন জীবনকে বেশ প্রভাবিত করতে পারে। স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমানো, খাবারের অভ্যাসে পরিবর্তন আনা এবং কিছু ওষুধের মাধ্যমে IBS-এর লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
গর্ভাবস্থায় লেবু খাওয়া যাবে কি না তা এই পোস্টের মাধ্যমে জানুন।
কিডনি ও মূত্রনালী সংক্রান্ত কারণ
কিডনিতে পাথর
আমাদের কিডনির ভেতরে ছোট ছোট পাথর তৈরি হতে পারে। এগুলো আসলে লবণ আর খনিজ পদার্থ জমে শক্ত দলার মতো হয়। যখন এই পাথরগুলো কিডনি থেকে প্রস্রাবের রাস্তা দিয়ে নিচে নামতে শুরু করে, তখনই পেটের বাম পাশে নিচের দিকে অথবা কোমরের আশেপাশে খুব তীব্র ব্যথা হয়। এই ব্যথা এতটাই বেশি হতে পারে যে রোগী ছটফট করতে থাকে। ব্যথার সাথে প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া, প্রস্রাবের সাথে রক্ত আসা, বমি বমি ভাব এমনকি বমিও হতে পারে। পাথর কত বড় বা কোথায় আছে, তার ওপর নির্ভর করে এর চিকিৎসা করা হয়। কখনো শুধু ওষুধ খেলেই হয়, আবার কখনো অপারেশনের দরকার পড়ে।
মূত্রনালীর সংক্রমণ (UTI)
যখন জীবাণু (যেমন ব্যাকটেরিয়া) আমাদের প্রস্রাবের নালী বা মূত্রাশয়ে ঢুকে সংক্রমণ ঘটায়, তখন তাকে মূত্রনালীর সংক্রমণ বা UTI বলে। এর ফলে পেটের বাম পাশে নিচের দিকে হালকা থেকে মাঝারি ব্যথা বা অস্বস্তি হতে পারে। এই ব্যথার সাথে প্রস্রাবের সময় জ্বালাপোড়া, বারবার প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবের রং ঘোলাটে বা গন্ধযুক্ত হওয়া, এবং তলপেটে একটা চাপ লাগার মতো অনুভূতি হয়। মাঝে মাঝে জ্বর বা ঠাণ্ডাও লাগতে পারে। মেয়েদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে এর চিকিৎসা করা হয়। যদি সময় মতো চিকিৎসা না করানো হয়, তাহলে সংক্রমণ কিডনি পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়ে বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে।
গর্ভাবস্থায় কি খেলে বাচ্চা ফর্সা হয়? এই পোস্টের মাধ্যমে জেনে নিন।
নারীস্বাস্থ্য সংক্রান্ত কারণ
ওভারিয়ান সিস্ট
নারীদের ডিম্বাশয়ে (Ovary) এক ধরনের থলির মতো গঠন তৈরি হতে পারে, যাকে ওভারিয়ান সিস্ট বলা হয়। বেশিরভাগ সিস্টই নিরীহ এবং নিজে থেকেই সেরে যায়। তবে, কখনো কখনো এই সিস্টগুলো বড় হয়ে গেলে বা ফেটে গেলে পেটের বাম পাশে নিচের দিকে হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা হতে পারে। ব্যথার সাথে পেট ফুলে যাওয়া, বমি বমি ভাব বা বমিও হতে পারে। যদি সিস্টের কারণে ব্যথা খুব বেশি হয় বা অন্য কোনো গুরুতর লক্ষণ দেখা দেয়, তবে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
এন্ডোমেট্রিওসিস
এন্ডোমেট্রিওসিস হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে জরায়ুর ভেতরে থাকা টিস্যু (যাকে এন্ডোমেট্রিয়াম বলে) জরায়ুর বাইরে, যেমন ডিম্বাশয়, ফ্যালোপিয়ান টিউব বা কোলনের মতো জায়গায় জন্মাতে শুরু করে। এই টিস্যুগুলো মাসিকের সময় জরায়ুর ভেতরের টিস্যুর মতোই রক্তপাত ঘটায়, কিন্তু বাইরে হওয়ায় রক্ত বের হতে পারে না এবং প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর ফলে পেটের বাম পাশে নিচের দিকে তীব্র ব্যথা হতে পারে, বিশেষ করে মাসিকের সময় ব্যথা অনেক বেড়ে যায়। ব্যথার সাথে অতিরিক্ত রক্তপাত, যৌন মিলনের সময় ব্যথা এবং সন্তান ধারণে সমস্যাও হতে পারে।
একটপিক প্রেগন্যান্সি
একটপিক প্রেগন্যান্সি বা জরায়ুর বাইরে গর্ভধারণ একটি অত্যন্ত জরুরি অবস্থা। সাধারণত, গর্ভধারণ জরায়ুর ভেতরে হয়। কিন্তু যখন ভ্রূণ জরায়ুর বাইরে, যেমন ফ্যালোপিয়ান টিউবে (যা ডিম্বাশয় থেকে জরায়ুতে ডিম্বাণু নিয়ে যায়) স্থাপিত হয়, তখন তাকে একটপিক প্রেগন্যান্সি বলে। ফ্যালোপিয়ান টিউব ফেটে গেলে পেটের বাম পাশে নিচের দিকে হঠাৎ করে তীব্র ব্যথা শুরু হয়, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ব্যথার সাথে রক্তপাত, মাথা ঘোরা এবং অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো লক্ষণও দেখা দিতে পারে। এটি একটি জরুরি মেডিকেল অবস্থা এবং জীবন বাঁচাতে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
গর্ভাবস্থায় বেশি শুয়ে থাকলে কি হয় তা জানতে এই লেখাটি পড়ুন।
সংক্রমণ ও প্রদাহজনিত কারণ
পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথার আরও কিছু কারণ হলো সংক্রমণ ও প্রদাহজনিত সমস্যা, যা পাকস্থলী, অন্ত্র বা অগ্ন্যাশয়কে প্রভাবিত করতে পারে।
গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস
গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস বলতে বোঝায় পাকস্থলী এবং অন্ত্রের সংক্রমণ বা প্রদাহ। এটি সাধারণত ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবী দ্বারা হয়। এর ফলে পেটের বাম পাশে নিচের দিকে বা পুরো পেটে ব্যথা হতে পারে। এই ব্যথা প্রায়শই মোচড়ানো বা খিঁচুনির মতো হয়। ব্যথার সাথে ডায়রিয়া, বমি, বমি বমি ভাব, জ্বর এবং পেটে অস্বস্তি দেখা দেয়। এটি সাধারণত “পেটের ফ্লু” নামে পরিচিত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজে থেকেই সেরে যায়, তবে পানিশূন্যতা রোধে পর্যাপ্ত তরল পান করা জরুরি।
প্যানক্রিয়াটাইটিস
প্যানক্রিয়াটাইটিস হলো অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ। অগ্ন্যাশয় একটি গ্রন্থি যা হজমে সাহায্যকারী এনজাইম এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন তৈরি করে। যখন অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ হয়, তখন এটি পেটের উপরের অংশে, বিশেষ করে উপরের বাম পেটে তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে। এই ব্যথা প্রায়শই পিঠের দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং খাবার খাওয়ার পর বাড়ে। প্যানক্রিয়াটাইটিসের সাথে বমি বমি ভাব, বমি, জ্বর এবং দ্রুত হৃদস্পন্দনও হতে পারে। এটি একটি গুরুতর অবস্থা এবং এর জন্য দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।
অন্যান্য কারণ
পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথার আরও কিছু কারণ আছে, যা আমাদের শরীরের অন্যান্য অংশের সাথে সম্পর্কিত। এগুলো কী কী এবং কেন এমন হয়, চলুন সহজভাবে জেনে নিইঃ
পেশীর টান বা আঘাত
অনেক সময় পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথা হতে পারে শুধু পেশীর টান বা আঘাতের কারণে। যদি আপনি হঠাৎ করে খুব ভারী কিছু তোলেন, পেটের ওপর চাপ পড়ে এমন কোনো কঠিন ব্যায়াম করেন, বা খেলার সময় পেটে কোনো আঘাত পান, তাহলে পেটের পেশীগুলোতে টান পড়তে পারে। এই টান বা আঘাতের কারণে ব্যথা অনুভূত হতে পারে, যা সাধারণত পেশী নড়াচড়া করলে বা চাপ দিলে বাড়ে। এই ব্যথা সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি হয় এবং বিশ্রাম নিলে বা গরম সেঁক দিলে কমে আসে।
প্লীহার সমস্যা
আমাদের পেটের বাম দিকে, পাঁজরের ঠিক নিচে একটি ছোট অঙ্গ আছে যার নাম প্লীহা (Spleen)। প্লীহা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং রক্ত পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। যদি কোনো কারণে প্লীহা বড় হয়ে যায় (যেমন কোনো সংক্রমণ বা রোগের কারণে) বা আঘাত পায় (যেমন কোনো দুর্ঘটনার ফলে), তাহলে পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথা হতে পারে। প্লীহা বড় হলে বা ফেটে গেলে ব্যথা তীব্র হতে পারে এবং জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
অন্ত্রের অবরোধ
যখন কোনো কারণে অন্ত্রের ভেতরে খাবারের চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাকে অন্ত্রের অবরোধ বা ইন্টেস্টাইনাল অবস্ট্রাকশন বলে। এটি একটি গুরুতর অবস্থা। অন্ত্রে খাবার বা মল আটকে গেলে পেটের বাম পাশে বা অন্য যেকোনো অংশে তীব্র ব্যথা হতে পারে। ব্যথার সাথে বমি, পেট ফাঁপা লাগা এবং মলত্যাগ করতে না পারা বা গ্যাস বের হতে না পারার মতো সমস্যা দেখা দেয়। যদি এমন লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত, কারণ এটি একটি জরুরি অবস্থা।
গর্ভাবস্থায় কি কি সবজি খাওয়া যাবে না জানেন? জেনে নিন।
ব্যথা কমাতে বিশেষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা
পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথার জন্য কিছু বিশেষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা আছে, যা ব্যথা কমানো এবং সুস্থ থাকতে সাহায্য করতে পারে। এই পদ্ধতিগুলো সহজ এবং বাড়িতেও চেষ্টা করা যায়, তবে প্রয়োজন হলে একজন ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
হালকা ও নিয়ন্ত্রিত ব্যায়াম
পেটের ব্যথার জন্য হালকা ও নিয়ন্ত্রিত ব্যায়াম খুবই কার্যকর। এর মধ্যে রয়েছে স্ট্রেচিং এবং কোর স্ট্যাবিলিটি এক্সারসাইজ। পেটের পেশী এবং কোমরের পেশীগুলোকে শক্তিশালী করতে এই ব্যায়ামগুলো সাহায্য করে। যখন পেটের বা কোমরের পেশী দুর্বল থাকে বা টান পড়ে, তখন ব্যথা হতে পারে। এই ব্যায়ামগুলো ধীরে ধীরে করলে পেশীর টান কমে, পেশী শক্তিশালী হয় এবং আঘাতজনিত ব্যথা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, শুয়ে পেটের পেশী হালকা করে টানটান করা বা ব্রিজিং এক্সারসাইজ করা যেতে পারে। তবে, মনে রাখবেন, কোনো ব্যায়ামেই যেন ব্যথা না বাড়ে।
হিট থেরাপি
ব্যথা কমানোর একটি সহজ ও কার্যকর উপায় হলো হিট থেরাপি। পেটের বাম পাশে যেখানে ব্যথা হচ্ছে, সেখানে গরম পানির ব্যাগ বা হট প্যাড ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। গরম সেঁক দিলে পেশীর খিঁচুনি এবং টান কমে আসে, কারণ তাপ রক্তনালীগুলোকে প্রসারিত করে এবং রক্ত চলাচল বাড়ায়। এতে ব্যথার স্থানে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ বাড়ে, যা ব্যথা সারাতে সাহায্য করে। ২০-৩০ মিনিট ধরে এই সেঁক দিলে আরাম পাওয়া যায়।
ঠিক ভঙ্গি (Posture) বজায় রাখা
দৈনন্দিন জীবনে সঠিক ভঙ্গি বা পোস্টার বজায় রাখা পেটের ব্যথা কমাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন বসেন, দাঁড়ান বা কোনো ভারী জিনিস তোলেন, তখন শরীরের ভঙ্গি ঠিক রাখা উচিত। যেমন, কম্পিউটারে কাজ করার সময় সোজা হয়ে বসা, বা মাটি থেকে কোনো ভারী জিনিস তোলার সময় কোমর সোজা রেখে হাঁটু ভেঙে তোলা—এসব নিয়ম মেনে চললে পেশীর ওপর অযথা চাপ কমে। সঠিক ভঙ্গি পেশী এবং মেরুদণ্ডের ওপর চাপ কমিয়ে ব্যথা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
রিল্যাক্সেশন ও ব্রিদিং এক্সারসাইজ
পেটের পেশী শিথিল করতে এবং মানসিক চাপ কমাতে রিল্যাক্সেশন ও ব্রিদিং এক্সারসাইজ খুব উপকারী। গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম (ডায়াফ্রাম্যাটিক ব্রিদিং) পেটের পেশীগুলোকে আরাম দিতে সাহায্য করে এবং শরীরের উত্তেজনা কমায়। এতে হজম প্রক্রিয়ার ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, যা গ্যাস বা বদহজমজনিত ব্যথা কমাতেও সাহায্য করতে পারে। শান্ত পরিবেশে চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়ার এবং ছাড়ার অভ্যাস করলে শরীর ও মন দুই-ই শান্ত হয়।
নিয়মিত হাঁটাচলা করা
নিয়মিত হাঁটা পেটের বাম পাশের ব্যথার কিছু কারণ, যেমন কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস বা বদহজম কমাতে খুব কার্যকর। হাঁটা অন্ত্রের নড়াচড়া বাড়ায়, যা হজমে সাহায্য করে এবং গ্যাস বা মল সহজে বের হতে সাহায্য করে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হালকাভাবে হাঁটলে পেটের সমস্যাগুলো অনেকটাই কমে আসে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যও ভালো থাকে।
ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ
যদি আপনার পেটের ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয়, খুব তীব্র হয়, বা যদি আপনি মনে করেন যে এটি কোনো আঘাতের কারণে হয়েছে, তবে একজন অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ নেওয়া উচিত। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট আপনার ব্যথার কারণ সঠিকভাবে নির্ণয় করে আপনার জন্য একটি ব্যক্তিগত থেরাপি প্ল্যান তৈরি করে দেবেন। এতে আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট ব্যায়াম, ম্যানুয়াল থেরাপি বা অন্য কোনো বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, যা আপনাকে দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করবে।
আপনার পেটের ব্যথার কারণ কী এবং এই চিকিৎসাগুলো আপনার জন্য কতটা উপযুক্ত, তা জানতে কি আপনি একজন ফিজথেরাপিস্টের সাথে পরামর্শ করতে চান? তাহলে আমাদের 01760-636324 , 01932-797229 এই নম্বরে যোগাযোগ করে বিস্তারিত ধারণা নিয়ে নিন। আমরা সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা পর্যন্ত বিরতিহীন সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি।
উপসংহার
পেটের বাম পাশে নিচের দিকে ব্যথা একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কিছু কারণ খুবই সাধারণ, যেমন গ্যাস, বদহজম বা কোষ্ঠকাঠিন্য, যা সাধারণত ঘরোয়া উপায়ে বা জীবনযাত্রার পরিবর্তনেই ঠিক হয়ে যায়। আবার কিছু কারণ তুলনামূলকভাবে বেশি গুরুতর হতে পারে, যেমন ডাইভার্টিকুলাইটিস, কিডনিতে পাথর, বা নারীদের ওভারিয়ান সিস্টের মতো সমস্যা। তাই, ব্যথার ধরন, তীব্রতা এবং এর সাথে অন্য কোনো লক্ষণ আছে কিনা, তা খেয়াল করা জরুরি।
যেহেতু এই ব্যথার কারণ অনেক এবং এর মধ্যে কিছু গুরুতর সমস্যাও থাকতে পারে, তাই সঠিক কারণ নির্ণয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিজে নিজে কারণ অনুমান করে চিকিৎসা না করে, কোনো ধরনের ব্যথা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, খুব তীব্র হয়, অথবা এর সাথে জ্বর, বমি, রক্তপাত, বা অন্যান্য অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। চিকিৎসক আপনার লক্ষণগুলো শুনে, শারীরিক পরীক্ষা করে এবং প্রয়োজনে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা যেমন রক্ত পরীক্ষা, প্রস্রাব পরীক্ষা, আলট্রাসনোগ্রাম বা কোলোনোস্কোপির মাধ্যমে ব্যথার সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে পারবেন।
মনে রাখবেন, পেটের বাম পাশে নিচের দিকের ব্যথাকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে এবং সঠিক চিকিৎসা নিলে গুরুতর জটিলতা এড়ানো সম্ভব। তাই, ব্যথার কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত না হলে বা ব্যথা বাড়তে থাকলে, কোনো ঝুঁকি না নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। আপনার স্বাস্থ্য আপনারই হাতে!
লিখেছেন-
ডাঃ সাইফুল ইসলাম, পিটি
বিপিটি ( ঢাবি ), এমপিটি ( অর্থোপেডিকস ) – এন.আই.পি.এস, ইন্ডিয়া
পিজি.সি. ইন আকুপাংচার, ইন্ডিয়া
স্পেশাল ট্রেইন্ড ইন ওজন থেরাপি, ইউ.এস.এ এবং ওজোন ফোরাম, ইন্ডিয়া।
ফিজিওথেরাপি কনসালট্যান্ট, ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার।
পরামর্শ পেতে – 01760-636324 , 01932-797229 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন।
আমাদের ফেইসবুক পেইজঃ ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার