গর্ভাবস্থায় বেশি শুয়ে থাকলে কি হয়? এর বিশেষ স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রতিকার কি?

প্রাথমিক ভূমিকা

যখন একজন গর্ভবতী মহিলা দীর্ঘ সময় ধরে শুয়ে থাকেন, তখন তার শরীরে রক্ত সঞ্চালন ধীর হয়ে যায়। এর প্রধান কারণ হলো মাধ্যাকর্ষণ শক্তির অভাব। সাধারণত, হাঁটাচলা বা নড়াচড়ার সময় আমাদের পায়ের পেশীগুলো রক্তকে হৃদপিণ্ডের দিকে পাম্প করতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন আমরা দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকি, তখন এই পাম্পিং প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। এর ফলে পায়ের শিরাগুলোতে রক্ত জমা হতে শুরু করে, যা পায়ে ফোলাভাব (ইডিমা) এবং অস্বস্তির কারণ হতে পারে। এই পোস্টে গর্ভাবস্থায় বেশি শুয়ে থাকলে কি হয় তা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

মারাত্মক ক্ষেত্রে, এটি ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (DVT) নামক একটি গুরুতর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে পায়ের গভীর শিরায় রক্ত জমাট বাঁধে এবং তা ফুসফুসে গিয়ে পালমোনারি এম্বোলিজমের মতো জীবন-ঝুঁকিপূর্ণ জটিলতা তৈরি করতে পারে। এছাড়াও, দীর্ঘক্ষণ একই অবস্থানে শুয়ে থাকার কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে কোমর ও পিঠে অতিরিক্ত চাপ পড়ে এবং ব্যথার সৃষ্টি হয়। মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে প্রসবের সময় পুশ করার ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং প্রসব প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হতে পারে।

হজম প্রক্রিয়া এবং বিপাকক্রিয়ার উপর অতিরিক্ত শুয়ে থাকার ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। শারীরিক কার্যকলাপ কমে গেলে অন্ত্রের মুভমেন্টও কমে যায়, যার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দেখা দেয়। গর্ভাবস্থায় এমনিতেই হরমোনের পরিবর্তনের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার প্রবণতা বাড়ে, তার উপর দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকলে এই সমস্যা আরও বাড়তে পারে। এছাড়াও, অলস জীবনযাপন মায়ের শরীরে অতিরিক্ত মেদ জমাতে সাহায্য করে, যা গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস (জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস) এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। মায়ের অতিরিক্ত ওজন শিশুর জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।

মানসিক স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাবও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। গর্ভাবস্থা একটি বিশেষ সময়, যেখানে মায়ের আবেগ এবং মানসিক অবস্থা দ্রুত পরিবর্তিত হতে পারে। দীর্ঘক্ষণ বিছানায় আবদ্ধ থাকলে একাকিত্ব, উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতা অনুভূত হতে পারে। সামাজিক কাজকর্ম থেকে দূরে থাকা এবং শারীরিক কার্যকলাপের অভাব মানসিক প্রশান্তি কমিয়ে দিতে পারে। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম এবং সামাজিক মেলামেশা মনকে সতেজ রাখে এবং ইতিবাচক মানসিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তাই, গর্ভাবস্থায় পরিমিত বিশ্রাম অবশ্যই প্রয়োজন, তবে তার পাশাপাশি হালকা হাঁটাচলা এবং অন্যান্য শারীরিক কার্যকলাপ মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত জরুরি। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একটি সুষম রুটিন মেনে চলা উচিত, যেখানে বিশ্রাম এবং হালকা কার্যকলাপের সঠিক সমন্বয় থাকে।

গর্ভাবস্থায় কত সপ্তাহে কত মাস জানতে এই পোস্টটি পড়ে নিন।

গর্ভাবস্থায় বেশি শুয়ে থাকার স্বাস্থ্যঝুঁকি

বেশি শুয়ে থাকার স্বাস্থ্যঝুঁকি

গর্ভাবস্থায় বেশি শুয়ে থাকলে পায়ে পানি আসতে পারে ও রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। নড়াচড়া কম হলে ওজন বাড়ে ও শরীর দুর্বল লাগে, যা বাচ্চা ডেলিভারির সময় সমস্যা করে। শ্বাস নিতে কষ্ট হতে পারে ও মন খারাপ লাগতে পারে। চিত হয়ে শুলে বাচ্চার অক্সিজেন কম হতে পারে। তাই, একটু হাঁটাচলা করা ভালো। আরও বেশ কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকির ব্যাপারে নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ

রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়া

দীর্ঘক্ষণ ধরে শুয়ে থাকলে আপনার শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়। এর প্রধান কারণ হলো শারীরিক কার্যকলাপের অভাব। যখন আমরা হাঁটাচলা করি বা নড়াচড়া করি, তখন আমাদের পেশীগুলো রক্তকে হৃদপিণ্ডের দিকে পাম্প করতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন আপনি দীর্ঘ সময় ধরে শুয়ে থাকেন, তখন এই পাম্পিং প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে, রক্ত পায়ের দিকে বা শরীরের অন্যান্য অংশে জমে যেতে পারে।

এই কারণে আপনার পায়ে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে, যা ইডিমা নামে পরিচিত। এছাড়াও, পায়ের শিরাগুলো ফুলে যেতে পারে, যাকে ভ্যারিকোজ ভেইন বলা হয়। সবচেয়ে গুরুতর ঝুঁকি হলো ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস (DVT), যেখানে পায়ের গভীর শিরায় রক্ত জমাট বাঁধে। এই রক্ত জমাট বাঁধা অংশটি ছিঁড়ে গিয়ে ফুসফুসে পৌঁছালে পালমোনারি এম্বোলিজমের মতো মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যা জীবননাশক হতে পারে।

ওজন বৃদ্ধি ও স্থূলতা

গর্ভাবস্থায় শরীরের কিছু ওজন বৃদ্ধি স্বাভাবিক, তবে অতিরিক্ত শুয়ে থাকার কারণে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। যখন আপনি কম শারীরিক কার্যকলাপ করেন, তখন আপনার শরীর কম ক্যালোরি খরচ করে। এর ফলে খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করা অতিরিক্ত ক্যালোরি শরীরে মেদ হিসেবে জমা হতে শুরু করে।

দীর্ঘ সময় ধরে নিষ্ক্রিয় থাকলে স্থূলতা দেখা দিতে পারে, যা গর্ভাবস্থায় বিভিন্ন জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়। অতিরিক্ত ওজন জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস (গর্ভাবস্থাকালীন ডায়াবেটিস) এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়াও, স্থূলতার কারণে প্রসব কঠিন হতে পারে এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হতে বেশি সময় লাগতে পারে।

মাংসপেশির দুর্বলত

গর্ভাবস্থায় দীর্ঘ সময় ধরে শুয়ে থাকলে আপনার শরীরের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। শারীরিক কার্যকলাপের অভাবে পেশী তাদের শক্তি এবং স্থিতিস্থাপকতা হারায়। এর প্রভাব বিশেষভাবে প্রসবের সময় অনুভূত হতে পারে।

প্রসবের সময় মায়ের শক্তিশালী পেশীর প্রয়োজন হয় বাচ্চাকে ধাক্কা দিয়ে বের করার জন্য। যদি গর্ভাবস্থায় পেশী দুর্বল হয়ে যায়, তবে প্রসব প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত এবং কঠিন হতে পারে। এছাড়াও, দুর্বল পেশীর কারণে প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের শরীর পুনরুদ্ধার হতে এবং স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে বেশি সময় লাগতে পারে। কোমর ও পিঠের পেশী দুর্বল হয়ে গেলে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার সমস্যাও হতে পারে।

শ্বাসকষ্ট ও শরীরের পানি স্তর কমে যাওয়া

অতিরিক্ত শুয়ে থাকলে শ্বাসকষ্টের অনুভূতি হতে পারে। এর কারণ হলো, দীর্ঘক্ষণ একই অবস্থানে থাকার ফলে ফুসফুসের কার্যকারিতা কিছুটা কমে যেতে পারে এবং শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। এছাড়াও, নিষ্ক্রিয়তার কারণে শরীরে রক্ত চলাচল কমে যাওয়ায় সামান্য পরিশ্রমেও ক্লান্তি এবং শ্বাসকষ্ট অনুভূত হতে পারে।

যদিও এটি সরাসরি ডিহাইড্রেশন বা শরীরের পানি স্তর কমে যাওয়া নয়, তবে দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকলে অনেক সময় পানি পানের প্রতি অনীহা দেখা যায়। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান না করলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে, যা গর্ভবতী মায়ের জন্য ক্ষতিকর। ডিহাইড্রেশনের কারণে মাথা ঘোরা, দুর্বলতা এবং অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া ও গর্ভপাতের ঝুঁকি

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত নিষ্ক্রিয় থাকা বা দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকার কারণে মায়ের রক্তচাপ বাড়তে পারে। যদিও এর সরাসরি কারণ এখনও স্পষ্ট নয়, তবে শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এবং শরীরে হরমোনের পরিবর্তনের প্রভাব থাকতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ মা ও শিশু উভয়ের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ।

কিছু ক্ষেত্রে, অতিরিক্ত শুয়ে থাকা এবং শারীরিক কার্যকলাপের অভাব গর্ভপাতের ঝুঁকিও বাড়াতে পারে বলে মনে করা হয়। তবে এর স্বপক্ষে জোরালো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। তবুও, গর্ভাবস্থায় সক্রিয় থাকা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা গর্ভপাতের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক হতে পারে।

মেজাজ ও মানসিক স্বাস্থ্যের প্রভাব

শারীরিক কার্যকলাপ আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যখন আপনি ব্যায়াম করেন বা হাঁটাচলা করেন, তখন আপনার মস্তিষ্ক থেকে এন্ডোরফিন নামক হরমোন নিঃসৃত হয়, যা মনকে প্রফুল্ল রাখে এবং স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকলে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।

অতিরিক্ত নিষ্ক্রিয়তা এবং সামাজিক মেলামেশা কমে যাওয়ার কারণে গর্ভবতী মহিলারা বিষণ্ণতা, উদ্বেগ এবং একাকিত্ব অনুভব করতে পারেন। গর্ভাবস্থার মতো সংবেদনশীল সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত হালকা ব্যায়াম এবং পছন্দের কাজকর্মে নিজেকে নিয়োজিত রাখলে মন ভালো থাকে।

বাচ্চার স্বাস্থ্যঝুঁকি

গর্ভাবস্থায় মায়ের অবস্থান গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে চিত হয়ে শুয়ে থাকলে গর্ভস্থ শিশুর অক্সিজেন সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। যখন একজন গর্ভবতী মহিলা চিত হয়ে শোন, তখন তার জরায়ু এবং গর্ভের শিশু প্রধান রক্তনালীগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যা মায়ের শরীর থেকে প্লাসেন্টা এবং শিশুর শরীরে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয়।

দীর্ঘক্ষণ ধরে এই অবস্থায় থাকলে গর্ভের শিশু পর্যাপ্ত অক্সিজেন নাও পেতে পারে, যা তার স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। কিছু গবেষণায় চিত হয়ে শোয়ার সাথে মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকির সামান্য সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গেছে। তাই, গর্ভাবস্থায় বিশেষ করে শেষ তিন মাসে বাম কাত হয়ে শোয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়, যাতে মায়ের এবং শিশুর শরীরে রক্ত সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে।

গর্ভাবস্থায় প্রথম মাসে তলপেটে ব্যথা হওয়ার কারণ জানতে এই পোস্টটি পড়ে নিন।

গর্ভাবস্থায় শোয়ার সঠিক ধরন ও সময়

শোয়ার সঠিক ধরন ও সময়

  • বাঁ দিকে কাত হয়ে শোয়াঃ যখন একজন গর্ভবতী মা বাম দিকে ফিরে শোন, তখন তাঁর পেটের ভেতরের বাচ্চাটা আরাম পায়। এর কারণ হলো, মায়ের শরীরের যে বড় রক্তনালীগুলো আছে, সেগুলোর উপর চাপ পড়ে না। ফলে, মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরে রক্ত আর খাবার ভালোভাবে পৌঁছাতে পারে। বাচ্চা সুস্থ আর ভালো থাকে। এটা মায়ের জন্যও ভালো, কারণ তারও শরীরে রক্ত চলাচল ঠিক থাকে।
  • চিত হয়ে শোয়া মানাঃ চিত হয়ে মানে চিৎ হয়ে আকাশের দিকে মুখ করে শোওয়া। এইভাবে শুলে মায়ের পেটের ভেতরের বাচ্চাটার একটু অসুবিধা হয়। মায়ের পেটের ভেতরের বাচ্চা এবং জরায়ু মায়ের পেটের নিচের দিকে থাকা বড় রক্তনালীগুলোর উপর চাপ দিতে পারে। এতে বাচ্চার কাছে অক্সিজেন কম পৌঁছাতে পারে, যা বাচ্চার জন্য ভালো না। তাই ডাক্তাররা বলেন, গর্ভাবস্থায় চিৎ হয়ে শোওয়া উচিত না।
  • ঘুমের সময়ঃ একজন গর্ভবতী মায়ের শরীর আর পেটের বাচ্চার জন্য দিনে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। এর বেশি সময় ধরে যদি কেউ শুধু শুয়ে থাকে, তাহলে মায়ের শরীর দুর্বল লাগতে পারে। বেশি শুয়ে থাকলে মায়ের রক্ত চলাচল কমে যেতে পারে, যা মায়ের পায়ে ফোলা বা অন্য সমস্যা করতে পারে। আর মায়ের শরীর খারাপ লাগলে পেটের বাচ্চারও অসুবিধা হতে পারে। তাই, ঘুমের সময়টা ঠিক রাখা দরকার এবং দিনের বেলা একটু হাঁটাচলা করা উচিত, শুধু শুয়ে থাকা ভালো না।

গর্ভাবস্থায় কি কি সবজি খাওয়া যাবে না জানতে পোস্টটি পড়ে নিন।

গর্ভাবস্থায় প্রতিকার ও করণীয়

প্রতিকার ও করণীয়ঃ বিস্তারিত আলোচনা

গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত শুয়ে থাকার ঝুঁকি কমাতে এবং সুস্থ থাকতে কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরি। নিচে আপনার দেওয়া পয়েন্টগুলোর আলোকে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. নিয়মিত হালকা হাঁটাচলাঃ প্রতিদিন অল্প সময়ের জন্য হলেও হালকা হাঁটাচলা করা গর্ভবতী মায়ের জন্য খুবই উপকারী। হাঁটার সময় আমাদের পায়ের পেশীগুলো সংকুচিত ও প্রসারিত হয়, যা রক্তকে হৃদপিণ্ডের দিকে পাম্প করতে সাহায্য করে। এর ফলে শরীরে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং পায়ে ফোলা বা রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়াও, হালকা হাঁটাচলা করলে শরীরের পেশীগুলো সচল থাকে এবং দুর্বল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। এমনকি, সামান্য সময়ের জন্য বাইরে হেঁটে এলে মনও সতেজ থাকে।

২. প্রি-নেটাল ব্যায়ামঃ গর্ভাবস্থার জন্য বিশেষভাবে তৈরি কিছু হালকা ব্যায়াম বা যোগব্যায়াম রয়েছে যা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করা যেতে পারে। এই ধরনের ব্যায়ামগুলো শরীরের বিভিন্ন পেশীকে শক্তিশালী করে, যা প্রসবের সময় এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে সহায়ক হতে পারে। প্রি-নেটাল ব্যায়াম কোমর ও পিঠের ব্যথা কমাতে, ঘুম ভালো করতে এবং মানসিক চাপ কমাতেও সাহায্য করে। তবে, কোনো ধরনের ব্যায়াম শুরু করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া উচিত।

৩. শোয়ার ধরনে পরিবর্তনঃ একটানা দীর্ঘ সময় ধরে একই ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা উচিত নয়। মাঝে মাঝে শোয়ার ধরণ পরিবর্তন করা জরুরি। বাম দিকে কাত হয়ে শোওয়া সবচেয়ে ভালো, তবে কিছুক্ষণ পর ডান দিকে কাত হতে পারেন। চিৎ হয়ে শোওয়া একেবারেই এড়িয়ে যাওয়া উচিত। রাতে ঘুমানোর সময়ও চেষ্টা করুন পাশ পরিবর্তন করে শুতে। প্রয়োজনে পিঠের নিচে বা দুই পায়ের মাঝে বালিশ ব্যবহার করতে পারেন যা আপনাকে আরাম দেবে এবং একভাবে শুয়ে থাকা থেকে বিরত রাখবে।

৪. বিশ্রামের সময় বিরতিঃ যদি আপনাকে দীর্ঘ সময় ধরে বিছানায় বিশ্রাম নিতে হয়, তাহলেও কিছুক্ষণ পর পর ছোট বিরতি নিন। প্রতি ঘণ্টায় অন্তত ৫-১০ মিনিটের জন্য বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ান এবং হালকা হাঁটুন অথবা আপনার পা এবং শরীরের অন্যান্য অংশ স্ট্রেচ করুন। এতে রক্ত চলাচল সচল থাকবে এবং শরীরের জড়তা কমবে। দীর্ঘক্ষণ বসে বা শুয়ে থাকার কারণে যে অস্বস্তি হতে পারে, তাও লাঘব হবে।

৫. মন ভালো রাখাঃ গর্ভাবস্থায় মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখা মায়ের ও শিশুর উভয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকলে অনেক সময় একাকিত্ব বা মানসিক চাপ অনুভব হতে পারে। তাই, এমন কিছু সৃজনশীল কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখুন যা আপনাকে আনন্দ দেয়, যেমন বই পড়া, গান শোনা, হালকা ছবি আঁকা বা পছন্দের কোনো শখচর্চা করা। পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের সাথে কথা বলুন এবং সামাজিক যোগাযোগ বজায় রাখুন। মন ভালো থাকলে শরীরও ভালো থাকবে।

৬. চিকিৎসকের পরামর্শঃ গর্ভাবস্থায় কখন কতটা বিশ্রাম নেওয়া উচিত এবং কতটা শারীরিক কার্যকলাপ করা উচিত, তা আপনার শারীরিক অবস্থা এবং গর্ভাবস্থার জটিলতার উপর নির্ভর করে। তাই, এই বিষয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা পাওয়ার জন্য আপনার চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা অপরিহার্য। তিনি আপনার জন্য একটি উপযুক্ত বিশ্রাম এবং কার্যকলাপের রুটিন তৈরি করে দিতে পারবেন, যা আপনার এবং আপনার গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য সর্বোত্তম হবে।

গর্ভাবস্থায় কি কি ফল খাওয়া যাবে না জানতে আমাদের এই পোস্টটি পড়ে নিন।

উপসংহার

গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীরের যত্ন নেওয়া খুবই জরুরি, আর এর একটা বড় অংশ হলো বিশ্রাম। তবে মনে রাখতে হবে, যেমন বেশি কাজ করা খারাপ, তেমনই দিনের পর দিন শুধু শুয়ে থাকাটাও মা আর পেটের বাচ্চার জন্য ভালো নয়। বেশি বিশ্রাম নিলে মায়ের শরীরে রক্ত চলাচল কমে যেতে পারে, শরীর দুর্বল লাগতে পারে এবং আরও নানা রকম সমস্যা হতে পারে। এমনকি, পেটের বাচ্চারও অসুবিধা হতে পারে।

সুস্থ থাকার জন্য গর্ভাবস্থায় শোয়ার সঠিক নিয়ম জানা দরকার। বাম দিকে কাত হয়ে শোওয়া সবচেয়ে ভালো, কারণ এতে মায়ের পেটের ভেতরের বাচ্চাটার কাছে রক্ত আর অক্সিজেন ঠিকমতো পৌঁছায়। চিৎ হয়ে শোওয়াটা এড়িয়ে যাওয়া উচিত। এর সাথে সাথে দিনের বেলা একটু হালকা হাঁটাচলা বা ডাক্তারের পরামর্শে কিছু ব্যায়াম করা দরকার। এতে মায়ের শরীর সচল থাকে আর প্রসবের সময়ও সুবিধা হয়।

সবচেয়ে জরুরি কথা হলো, গর্ভাবস্থায় নিজের শরীরের যত্ন কিভাবে নিতে হবে, কতটা বিশ্রাম দরকার আর কতটা হাঁটাচলা করা উচিত – এই সবকিছুই ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে ঠিক করে নেওয়া উচিত। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে এবং সঠিক নিয়মগুলো পালন করলে মা ও বাচ্চা দুজনেই সুস্থ থাকবে এবং গর্ভাবস্থাটা ভালোভাবে কাটানো যাবে।

 

ডাঃ সাইফুল ইসলাম, পিটি
বিপিটি ( ঢাবি ), এমপিটি ( অর্থোপেডিকস ) – এন.আই.পি.এস, ইন্ডিয়া
পিজি.সি. ইন আকুপাংচার, ইন্ডিয়া
স্পেশাল ট্রেইন্ড ইন ওজন থেরাপি, ইউ.এস.এ এবং ওজোন ফোরাম, ইন্ডিয়া।
ফিজিওথেরাপি কনসালট্যান্ট, ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার।

পরামর্শ পেতে – 01760-636324 , 01932-797229 (সকাল ৯.০০ থেকে রাত ৯.০০ টা) এই নম্বরে কল করুন এবং এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নিন

আমাদের ফেইসবুক পেইজঃ ভিশন ফিজিওথেরাপি সেন্টার

Visionphysiotherapy Centre
Visionphysiotherapy Centre
Articles: 109

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *